শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন
পহেলা মে ছিল সারা বিশ্বের শ্রমিকদের একটি বিশেষ দিন- মে দিবস। গত শতকে সাম্যবাদে বিশ্বাসীরা স্লোগান দিতেন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এখনও দেন। কয়েক দশক আগে বাংলাদেশে ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ওই আন্দোলনটির যথেষ্ট উপকারিতা পাওয়া যায়, যা ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিয়ামক ভূমিকা রাখে। কিন্তু তারপরও তখনকার কিছু ঘটনায় আমরা নানা কৌতুককর উপাদানের দেখা পেয়েছি।
যেমন পানি হয়তো ফোটানো হয়েছে, কিন্তু ফোটানো পানি ঠাণ্ডা হতে অনেক সময় লাগছে বলে কলসি থেকে না ফোটানো কিছু ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে নেয়া হয়েছে, যাতে তখনই খাওয়া যায়। আবার যে পাত্রে ফোটানো পানি রাখা হচ্ছে সে পাত্রটা হয়তো সঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয়নি বা ঠিকভাবে পরিষ্কার না করা গ্লাসে করে হয়তো পানিটা খাওয়া হচ্ছে। তাতে দেখা গেল, পানি ফোটানোর ফলাফল শূন্য।
করোনার ভয়াবহতার মধ্যে সম্প্রতি গার্মেন্ট কারখানা চালু করে দেয়ায় শ্রমিকদের মধ্যেও ওই একই ধরনের চিত্র দেখা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বলা হচ্ছে, গার্মেন্টে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শ্রমিকরা কাজ করবে। শ্রমিকদের কারখানায় ঢোকার সময় এবং কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে স্যানিটাইজ করা হবে এবং যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখেই তারা কাজ করবে।
যদিও আমরা পত্রিকায় বা টিভিতে দেখেছি, অনেক কারখানায়ই নামকাওয়াস্তে নম নম করে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, যা যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যথেষ্ট নয়। তারপরও ধরা যাক কারখানায় হয়তো শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করবে, কিন্তু সমস্যা রয়ে যাবে তারা যেখানে থাকে সেখানে। তারা প্রায়ই এক ঘরে গাদাগাদি করে ৪-৫ জন থাকে, ১০-১৫ জন বা তারও বেশি জনকে একটিমাত্র টয়লেট বা বাথরুম ব্যবহার করতে হয়।
আবার যাতায়াতের সময়ও তাদের গাদাগাদি করে কোনো গাড়িতে চড়তে হয়। হেঁটে যাতায়াতের বেলায়ও তারা গাদাগাদি করেই চলাচল করে। সুতরাং যে কথাটি বলা হচ্ছে, শ্রমিকরা কারখানায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করছে, কথাটি কিছু কারখানার ক্ষেত্রে ঠিক হলেও অধিকাংশের বেলায়ই খাটে না। আর কারখানা ছুটির পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো আদৌ কোনো অবকাঠামোগত বাস্তব অবস্থায় শ্রমিকরা নেই।
এটা অবশ্য আমরা সবাই পত্রপত্রিকা পড়ে ও নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি যে, যে ধরনের স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হচ্ছে সেটা শহরের মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যায়ের মানুষের পক্ষেই পালন করা সম্ভব। যেসব শ্রমিক শহরে থাকে বা বাসাবাড়িতে কাজ করে যে গৃহকর্মী নারীরা, তাদের পক্ষে নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, যথাযথভাবে সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হাত পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না বাস্তবতার কারণেই।
গ্রামেও এটা সত্য। করোনাকালে সবাইকে ঘরে থাকার কথা বলা হলেও গ্রামে ঘরে থাকা বা উঠানে থাকার মধ্যে পার্থক্য নেই। তাদের হয়তো সারাক্ষণ ঘরে থাকার দরকারও নেই, কিন্তু তারা আশপাশের মাঠে বা বাগানে যেখানে কাজ করে সেখানে তাদের নিয়মিত পরিষ্কার পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মতো কোনো সুবিধা নেই বা সঙ্গতিও নেই। কাজেই মোটাদাগে যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হচ্ছে সেটা খুব একটা কার্যকর নয়।
আবার এটাও সত্য, অনেকের জন্যই বর্তমান অবস্থাটা অনেকটা ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’-এর মতো। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে না খেয়ে মরতে হবে, আর না মানলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং কাজে যোগদান না করে তাদের উপায় নেই। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই কোথায় কীভাবে কতটুকু ব্যবস্থা নেয়া যায়, সেদিকে আমাদের আরও মনোযোগ দেয়া দরকার।
সম্প্রতি একটা খবরে দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্রে ৭-৮ জন অতি ধনী করোনার সময়ে আরও ধনী হয়েছে, যার মূল উৎস যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কারা সুবিধা নেবেন সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আগে থেকে ঋণখেলাপি তাদেরকে এ প্যাকেজ থেকে সুবিধা দেয়া মোটেই বাস্তবসম্মত হবে না।
বর্তমানে একটা কথা চালু হয়েছে যে করোনা লেভেলার, অর্থাৎ করোনা ধনী-দরিদ্র বাছবিচার করে না, সবাইকে সমানভাবে আঘাত করে। কার্যত এটাও একটা মিথ। যেমন আমরা ৩০-৪০ বছর আগে দেখেছি বিশ্বব্যাংকের ট্রিকল ডাউন থিউরি, যেখানে বলা হয়েছে যে কোনো একটি দেশের উন্নয়ন হলে, অর্থাৎ কেকটা বড় হলে তার সুফল সবাই কিছু না কিছু পাবে।
কিন্তু এই থিউরিও বাস্তবে কাজে দেয়নি। কারণ দেখা গেছে উপরে থাকা জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ধনীরাই অনেক বেশি ধনী হয়েছে, পিরামিডের নিচে যারা আছে সেই দিন এনে দিন খাওয়া অধিকাংশ মানুষের অবস্থার কোনোই পরিবর্তন হয়নি। এ বিষয়টি করোনার ধাক্কায় এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যখন নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ের মানুষও খাদ্যের অভাবে ভুগছে।
এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, করোনার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়ছে দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী, যারা দরিদ্র তাদের ওপর। চিকিৎসায় তাদের এমনিতেই অভিগম্যতা নেই, করোনায় আক্রান্ত হলে তো আরও নেই। তাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু যারা সমাজের ধনিকগোষ্ঠী, তাদের প্রফিট একটু কমলেও তারা বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেবে।
ধনীদের শুধু বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া জীবনধারণ বা অন্য কোনো কিছুতেই সুবিধার কোনো কমতি নেই। তাদের কেবল বিলাসিতা প্রদর্শনে একটু ব্যাঘাত ঘটছে, চাইলেই বিদেশে যেতে পারছে না। দেশে বিদ্যমান চিকিৎসা সুবিধা তারাই বেশি পাচ্ছে ও পাবে। সুতরাং করোনা ধনী-দরিদ্রকে সমান চোখে দেখে এটাও শেষ পর্যন্ত একটা মিথ। তবে এটা ঠিক, করোনাকে পরাজিত করতে হলে ধনী-দরিদ্র সব দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। এটা এখন সবাই উপলব্ধি করছেন।
করোনার এই অভিঘাত থেকে দ্রুত বের হয়ে আসার জন্য অনেকের অনেক পরামর্শ আমরা পত্রপত্রিকায়, দেশি-বিদেশি খবরে দেখতে পাই, সংক্ষিপ্তভাবে সেগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা যায়। পরামর্শগুলোর কয়েকটি হল- অর্থনীতির চাকাকে পুনরায় সচল করে তোলা, কৃষি উৎপাদন বা খাদ্য উৎপাদনে যাতে কোনো ঘাটতি না হয় সেদিকে নজর দেয়া, বাংলাদেশের জন্য ইনফরমাল ও এসএমই খাতকে প্রাধান্য ও প্রণোদনা দেয়া।
অর্থনীতির চাকাকে সচল করার জন্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি একটি পরামর্শ দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে টাকা ছাপিয়ে জনগণের কাছে টাকা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে অবশ্য আমাদের দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী একমত পোষণ করেন না। কারণ এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহরকম বেড়ে যাবে। সেখানে পরামর্শ আসছে অপ্রয়োজনীয় খাতে প্রণোদনা না দিয়ে বা সরকারি অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে টাকার সংস্থান করা।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করোনার ধাক্কায় কয়েকটি বিষয়ে আমাদের চোখের কালো গ্লাস সরে গিয়েছে। তার একটি হল- পরিবহন খাতের শ্রমিকরা নিয়মিত যে চাঁদা দেয়, শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সেই টাকায় কী করেন বা না করেন তার কোনো হিসাব বা দায়বদ্ধতা নেই। চাঁদা হিসেবে তারা প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা তুললেও এই করোনার সময়ে পরিবহন শ্রমিক ও ড্রাইভাররা তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে না। সুতরাং ট্রেড ইউনিয়নের চাঁদা আদায় ও তার ব্যবহারে স্বচ্ছতা আনা খুব জরুরি।
বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দেশে কোনো বিপর্যয় মোকাবেলা অত্যন্ত কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। সুতরাং জনসংখ্যা পরিকল্পনায় আমাদের উদাসীনতা দেখানোর বিলাসিতায় লাগাম দিতে হবে। তা না হলে স্বাভাবিক সময়েও সব জনগণকে বর্তমান যুগোপযোগী নাগরিক সেবার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত দুরূহ হবে।
করোনার ভয়াবহতা আমাদের জন্য যে শিক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে, সেখান থেকে আমরা যদি আমাদের ভুলগুলো শুধরাতে না শিখি, ভবিষ্যতে ঠিকভাবে উঠে দাঁড়ানো যেমন বিলম্বিত হবে, তেমনি আগামী সময়ের সম্ভাব্য অন্য কোনো বিপর্যয়কেও আমরা দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হব। যত দ্রুত আমরা এসব বিষয়ে মনোযোগী হব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
Leave a Reply