মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বাংলা বলতে বাবার শেখানো এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ- সংখ্যাগুলো নির্দি্বধায় বলে গেলেন। একটু পর পুরো বাক্যও মুখে চলে এলো বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করা মার্গারিটার, ‘আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।’ সেই ১৬ বছর আগে বাবার সঙ্গে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বছর দশের ছোট্ট মার্গারিটা। তারপর এই, এবার মায়ের সঙ্গে স্বামী আলেক্সান্ডারকেও নিয়ে এসেছেন পিতৃভূমি দেখাতে। পরিকল্পনা আছে, এক দিনের জন্য রাজশাহীতে বাবা মামুনের ভিটেতেই যাবেন রিও অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী রাশিয়ান অ্যাথলেট মার্গারিটা মামুন।
বঙ্গবন্ধু পঞ্চম সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস টুর্নামেন্টের শুভেচ্ছাদূত হয়ে ঢাকায় আসা মার্গারিটা গতকাল মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশি জিমন্যাস্টদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। ১৬ বছর আগে বাংলাদেশে এলেও সেই সময় তারকা ছিলেন না মার্গারিটা। ১০ বছরের সে মেয়েটি এখন পুরো বিশ্বের তারকা। রিও অলিম্পিকে সোনা জয়ের পর মার্গারিটা যখন পদকের জন্য মঞ্চে উঠেছিলেন, তখন সাউন্ড বক্সে বেজে উঠেছিল ‘বেঙ্গল টাইগার্স’। টিভিতে দেখা সেই স্বপ্নের তারকাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে তার সঙ্গে মিলিতভাবে পারফর্ম করার সঙ্গে সেলফিও তুলেছেন বাংলাদেশের
জিমন্যাস্টরা। রাশিয়ায় বড় হলেও তার হৃদয় জুড়ে আছে বাংলাদেশ। এক যুগেরও বেশি সময় পর পিতৃভূমিতে আসার অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেন মার্গারিটা মামুন, ‘এখানে (বাংলাদেশে) আসতে পেরে আমি খুবই রোমাঞ্চিত। অন্যরকম ভালা লাগা কাজ করছে আমার মধ্যে। আমার বয়স যখন ১০, তখন বাবার সঙ্গে এসেছিলাম, সম্ভবত ১৬ বছর আগে। এবার আসাটা আমার জন্য বিশেষ কিছু। কারণ এই প্রথম আমার পুরো পরিবার, আমার স্বামী এসেছে। দ্বিতীয় বাড়িতে আসতে পারাটা যে কত আনন্দের, তা আমি ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না।’
স্বামী আলেক্সান্ডারের হাত ধরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রবেশ করার পর অবাক মার্গারিটা মামুন। পাঁচ বছর আগে রিও অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণ জেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্গারিটা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, তার জন্য এত বড় আয়োজন। মঞ্চের চারপাশে তার স্বর্ণজয়ী ছবি। মা সোভিয়েত ইউনিয়নের রিদমিক জিমন্যাস্টস আনা এবং রাশিয়া থেকে আসা পরিবারের আরও সদস্যের উপস্থিতিতে সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে সংবর্ধনা দেওয়া হয় মার্গারিটা মামুনকে। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতা মার্গারিটাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অতিথিরা। তার সঙ্গে কেউ সেলফিতে মগ্ন, আবার কেউ বা আড্ডায় পেছনের গল্পগুলো তুলে ধরেছেন। রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মার্গারিটাকে তার বাবার সঙ্গে তোলা ছবিগুলো দেখিয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিয়েছেন। আতিথেয়তায় মুগ্ধ ২৫ বছর বয়সী এ জিমন্যাস্টসও কখনও রাশিয়ান আবার কখনও বা ইংরেজিতে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন।
জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই রাশিয়ায়। তার পরও বাবার পরিচয়টাই সামনে চলে আসে। মা রাশিয়ান, বাবা বাংলাদেশি; তাই তো মার্গারিটা মামুন নিজেকে হাফ রাশিয়ান এবং হাফ বাঙালি হিসেবেই মনে করছেন, ‘আমি সবসময় বাংলাদেশকে আমার হৃদয়ে ধারণ করে রাখি। আমি যখন স্কুলে যেতাম, তখন সব বাচ্চা কিন্তু রাশিয়ান ছিল, কিন্তু আমি পুরোপুরি রাশান ছিলাম না। আমি হাফ বাংলাদেশ এবং হাফ রাশিয়ান। স্কুল, জিমন্যাস্টিকস সেশন এবং আমার হাজবেন্ড সবাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে যে, আমি অর্ধেক বাঙালি এবং অর্ধেক রাশান। নিজেকে একজন বাঙালি ভাবতে আমি গর্ববোধ করি। আমার হৃদয়ে বাংলাদেশ।’ পৃথিবীর যেই প্রান্তে গেছেন, তাকে দেখলেই বাংলাদেশিরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ মার্গারিটা মামুন, ‘আমি এখানে যখন এসেছিলাম, তখন বড় কোনো তারকা ছিলাম না। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের আগে এবং অলিম্পিকের পরে আমি দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসে। যখন মস্কোয় বাংলাদেশি মানুষ আমাকে দেখত, দৌড়ে ছুটে আসত। টোকিও অলিম্পিকে যখন উদ্বোধন অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন প্রতিটি দেশের মার্চপাস্ট হচ্ছিল, আমি অপেক্ষায় ছিলাম, কখন বাংলাদেশ দল মাঠে প্রবেশ করবে। যখনই দেখেছি বাংলাদেশের পতাকা হাতে ডেলিগেটরা মাঠে প্রবেশ করছেন, তখন আমার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। আমি যখন কানাডায় ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে গিয়েছিলাম, সেখানেও দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ আমার কাছে ছুটে এসেছে। আমি তাদের বলতে শুনেছি, তোমার বাবা বাংলাদেশি, তুমি বাঙালি। সত্যি কথা বলতে কি, যেখানে গিয়েছি বাংলাদেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। তাই আমি সবসময় নিজেকে হাফ বাঙালি মনে করি।’
বাবা মামুনের সঙ্গে এবারের আগে আরও চারবার রাজশাহীতে গিয়েছিলেন মার্গারিটা। পঞ্চমবার পুরো পরিবার নিয়ে এলেও নেই বাবা। অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের এক সপ্তাহ পরই বাবা মামুন চলে যান না ফেরার দেশে। পিতৃভূমিতে এসেছেন, অথচ বাবা নেই, ব্যাপারটি মানতে কষ্ট হচ্ছে মার্গারিটার, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল আমি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছু করি। রিও থেকে স্বর্ণপদক নিয়ে মস্কোয় ফেরার পর বাবা তো খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু আমাদের সেই আনন্দ অল্প কিছুদিন পর বেদনায় রূপ নেয়। হঠাৎই বাবা চলে যান। সেই সময়টা আমাদের পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক ছিল। বাবা হারানোর যন্ত্রণা এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সর্বশেষ তো বাবার সঙ্গেই বাংলাদেশি এসেছিলাম; কিন্তু এবার তো বাবা ছাড়া সবাই আছেন। বাবার জন্য খারাপ লাগছে।’ বাবার মুখে শুনেছেন রাজশাহীর আম বিখ্যাত। বাবা মামুনও রাশিয়ায় আম নিয়ে যেতেন। এখন বাবা নেই, তবে কেউ যদি ঢাকা থেকে মস্কো যান, মার্গারিটা তাকে আম নিয়ে যেতে বলেন। বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকসে সাহায্য করার ইচ্ছা আছে মার্গারিটার। তবে আপাতত কোচ হয়ে এখানে আসার কোনো ইচ্ছা নেই তার, ‘আমি জানি, এখানে আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস আছে। যদিও আমি রিদমিক জিমন্যাস্টিকস খেলেছি, তার পরও আমি এখানে সাহায্য করার চেষ্টা করব (গতকালই বাংলাদেশের জিমন্যাস্টদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন)। আসলে আমি মাত্র তো এখানে এসেছি। অনেক দিন পর আমার এখানে আসা। তবে এবারই আমার শেষবার আসা নয়, আমি বারবার বাবার দেশে আসব।’
Leave a Reply