মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫০ পূর্বাহ্ন
২০১৪ সালে পুলিশের হেফাজতে জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৫ জন আসামীর মধ্যে তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। অপর দুই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
যে দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তারা মূলত পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছিলেন।
বাংলাদেশে নানা ঘটনায় প্রায়শই আলোচনায় আসে পুলিশের সোর্স বা অনুচররা।
মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেন অনেক সময়ই পুলিশের সোর্সরা নিজ স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করে ।
আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সোর্সদের ওপর এতো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে তাদের দেয়া তথ্য যাচাই না করেই অভিযান চালায় যাতে অনেক নিরীহ মানুষ বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হয়।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলছেন সোর্সদের দেয়া তথ্য যাচাই করেই পুলিশকে এগুতে হয়, তবে অনেক সময় নিজেই সঠিক তদন্তের প্রয়োজনে সোর্স নিয়োগ করতে হয় কর্মকর্তাদের।
তিনি বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সোর্স বা ইনফরমার থাকা অপরিহার্য। এটা ছাড়া তো কাজ করা যাবেনা। অনেক সময় সোর্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে সেটারও তদন্ত হয়”।
তবে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বা প্রবিধান না থাকায় পুলিশের সোর্স বিষয়টি জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যায়।
“তাদের তথ্য পাওয়ার জন্য ব্যবহার করার বদলে অনেক সময় ক্ষমতা প্রদর্শন বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। আবার এই সুযোগে সোর্সরাও অনেকে পুলিশকে ব্যবহার করে ফেলে। পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগও অনেক সোর্সের বিরুদ্ধে উঠেছে,” বলছিলেন মিস্টার খান।
মোখলেসুর রহমান বলছেন এটা পুরোটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কৌশলের ওপর।
“গোপন সংবাদ বের করাই মূল উদ্দেশ্য থাকে। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষও সোর্স হতে পারে। আবার কোনো বিজ্ঞজনও হতে পারেন সোর্স। আবার কখনো কখনো কোনো ঘটনা বা চক্রে জড়িত কাউকেও সোর্স করা যেতে পারে। তবে এটি পুরোটাই নির্ভর করে কর্মকর্তার দক্ষতা বা কৌশলের ওপর”।
মিস্টার রহমান বলেন পুলিশ কর্মকর্তার যদি যথাযথ কানেকশন না থাকে তাহলে তিনি তো কাজ করতে পারবেননা এবং কোনো তথ্যও উদঘাটন তিনি করতে পারবেননা।
ঢাকায় সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তা বলছেন, “ধরুন মাদক ব্যবসার তথ্য তো আমরা এমনি পাবোনা। সেখানে আমার সোর্স লাগবে। আবার বড় ক্রাইম হলে আমরা চেষ্টা করি তাদের মধ্যেই একজনকে সেট করতে। সেক্ষেত্রে তাকে হয়তো আর্থিক সুবিধা দিয়ে তথ্য নেই”।
অর্থাৎ অপরাধ ও অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহে নিজেদের উদ্যোগেই বিভিন্ন ব্যক্তিকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
“কিছু সোর্স আছে খারাপ জগতের। অনেকে আছেন পেশাদার সোর্স যারা খবর দিয়ে টাকা নেয়। একটা মার্ডার হলো তখন হয়তো ঘটনার আশেপাশের কাউকে টাকার বিনিময়ে সেট করলাম খবর দেয়ার জন্য,” বলছিলেন ঢাকার ওই কর্মকর্তা।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে সাধারণত রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন ছোট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষকে পুলিশ সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে।
আবার এদের অনেককে তথ্যের বিনিময়ে টাকা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত।
যদিও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যখন এই টাকা দেওয়া হয়, তখন তাকে ‘অপারেশন মানি’ হিসেবে বলা হয়ে থাকে।
মোখলেসুর রহমান বলছেন সে ধরণের কোনো নিয়ম নীতি নেই এবং এটি সম্পূর্ণ গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করে তিনি কিভাবে কাকে সোর্স বানাচ্ছেন।
“তবে গোয়েন্দা কাজ করতে কিছু অর্থ কড়ি দেয়া হয়। সোর্স মানি হিসেবে যেটি ব্যবহার করা যেতে পারে,” বলছেন তিনি।
প্রসঙ্গত ২০১৯ সালের পুলিশ সপ্তাহে ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে সোর্স মানির বিষয়টি উঠে এসেছিলো বলে কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ঢাকার আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নীতি না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যেখানে যে বিষয়ে কাজ করেন সেখানে সোর্স তৈরি করেন যাতে করে দরকারি তথ্য তিনি পান।
“এটা একেবারেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়। কখনো কখনো কোনো বিশেষ কারণে তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন যে সোর্স হিসেবে কার সাথে কাজে যাচ্ছেন বা কোনো অপারেশনে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিনি প্রয়োজন মনে করলে জানাবেন। না হলে নাই”।
যদিও ঢাকার একটি থানায় কর্মরত একজন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলছেন সোর্স নিয়োগের একটা নীতিমালা আছে তবে তারা অনুমোদিত সোর্স যারা রাষ্ট্রের টাকা পান।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রেডবুকে (গোপনীয় নথি যা পুলিশ সুপার থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখতে পারেন) এ সম্পর্কিত তথ্য থাকে।
তবে ব্যক্তি সোর্স নিতান্তই পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততা ও যোগাযোগ বা বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে, বলছিলেন তিনি।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি জেলায় কর্মরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন পুলিশ কর্মকর্তাকে যিনি তথ্য দিবেন তার নাম পরিচয় প্রকাশ করা যায়না।
মিস্টার রহমান বলেন, “সোর্স বা ইনফরমার নানা ধরনের হয়ে থাকে এটি সত্যি। কিন্তু আমাদের কর্মকর্তারা তারা তাদের নিয়ে কাজ করেন তারা এসব ব্যক্তিদের নাম পরিচয় প্রকাশ করতে পারেননা।”
“মনে রাখতে হবে সে হয়তো আমাদের এমন তথ্য দিচ্ছেন যা বড় কোনো অপরাধ প্রতিরোধে সহায়তা করছে বা অপরাধীকে ধরতে সহায়তা করছে”।
Leave a Reply