বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন
বর্তমানে যে দেশটি গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র বা ডিআরসি নামে পরিচিত সেদেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণকে অপহরণ করা হয় ১৯০৪ সালে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
অপহরণের পর ১৯০৬ সালে তাকে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয় কয়েক সপ্তাহের জন্য।
তাকে রাখা হয়েছিল বানরের সাথে। ফলে দর্শনার্থীদের অনেকেই বুঝতে পারতেন না এটা আসলে কী- মানুষ নাকি বানর? ছোটখাটো দেখতে, গায়ের রঙ কালো, দাঁত অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।
তার পরনে পোশাক ছিলো কিন্তু পায়ে কোন জুতা ছিলো না।
নিশানা লক্ষ্য করে ধনুক দিয়ে তীর ছুঁড়ে মারার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন তিনি।
নানা রকমের কসরত দেখিয়ে তিনি দর্শকদের আনন্দ দিতেন। সেসময় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায় দর্শকদের প্রধান আগ্রহ ছিল তার ধারালো দাঁত।
বানরের খাঁচায় আটক এই আফ্রিকান লোকটির নাম ছিলো ওটা বেঙ্গা। চিড়িয়াখানার দলিলে দেখা যায় তার উচ্চতা ছিল চার ফুট ১১ ইঞ্চি। ওজন ১০৩ পাউন্ড। বসতি ছিলো কঙ্গোর কাসাই নদী তীরবর্তী গ্রামে।
খাঁচার বাইরে একটি নোটিসে লেখা ছিল: ”সেপ্টেম্বর মাসের প্রত্যেকদিন দুপুরে তাকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।”
সেসময় প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তাকে দর্শনার্থীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে শিশুরা তাকে দেখে খুব মজা পেতো, হাসাহাসি করতো এবং জোরে চিৎকার করে উঠতো।
পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে তাকে দেখতে কোনো কোনোদিন খাঁচার আশেপাশে একসঙ্গে পাঁচশো লোকও জড়ো হয়েছে।
শুরুতে তাকে একটি ছোট খাঁচায় রাখা হয়েছিল কিন্তু পরে দর্শকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তাকে একটি বড় খাঁচায় সরিয়ে নেওয়া হয়। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, ওটা বেঙ্গার কারণে চিড়িয়াখানায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে ব্রংস চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দী করে রাখার পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করে।
কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয় তাকে প্রদর্শনের জন্য সেখানে আটকে রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে তার নিরাপত্তার স্বার্থে, যাতে করে সে এখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে।
ওটা বেঙ্গাকে বন্দী করে রাখার এই ইতিহাস ধামাচাপা দিতে কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনার ১১৪ বছর পর তাকে খাঁচায় ভরে প্রদর্শনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি যারা নিউ ইয়র্কের ওই চিড়িয়াখানাটি পরিচালনা করে।
নিউ ইয়র্কের ব্রংস জাদুঘরে কৃষ্ণাঙ্গ ওটা বেঙ্গাকে প্রদর্শনীর জন্য প্রথম হাজির করা হয়েছিল ১৯০৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর। এর পর দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপে এই ঘটনা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি শুরু হলে তাকে ওই বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে লেগে যায় এক শতাব্দীরও বেশি সময়।
বর্তমান সময়েও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি নানা আচরণ থেকে বোঝা যায় বর্ণবাদ এখনও যুক্তরাষ্ট্রে কতোখানি প্রকট।
পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যুর পর যখন বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও বিক্ষোভ চলছে তখন এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ওটা বেঙ্গাকে চিড়িয়াখানায় বন্দী করে রাখার ঘটনা আবারও দেশটির সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হিসেবে উঠে এসেছে।
ওটা বেঙ্গাকে চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি এটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালায়।
চিড়িয়াখানার আর্কাইভে পাওয়া ১৯০৬ সালের একটি চিঠিতে দেখা যায় এই প্রদর্শনীর সমালোচনা শুরু হলে কর্মকর্তারা তখন ঘটনাটিকে আড়াল করার জন্য একটি গল্প ফাঁদতে শুরু করেন। তারা বলতে শুরু করেন যে ওটা বেঙ্গা আসলে ওই চিড়িয়াখানাতে একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
এর পরের কয়েক দশক ধরে তাদের এই বানোয়াট গল্প কাজে দিয়েছিল।
এসব তথ্যের উৎস স্পেকটাকল: দ্য এসটনিশিং লাইফ অফ ওটা বেঙ্গা
ওটা বেঙ্গার মৃত্যুর পর ১৯১৬ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে তাকে প্রদর্শন করার গল্প প্রত্যাখ্যান করা হয়।
পত্রিকাটির নিবন্ধে বলা হয়, “তিনি এমন একটা কাজ করতেন যে মনে করা হতো তাকে বুঝি প্রদর্শনীর জন্য বানরের খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের সঙ্গে এই বিবরণের মিল নেই।
ব্রংস চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা উইলিয়াম ব্রিজেস ১৯৭৪ সালে দাবি করেন যে সেসময় আসলেই কী ঘটেছিল সেটা জানা যায় নি।
তিনি গ্যাদারিং অফ অ্যানিমেলস বলে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন: “ওটা বেঙ্গাকে কি আসলেই অদ্ভুত ও বিরল প্রাণী হিসেবে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছিল?”
কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তো তারই ভালো করে জানার কথা ছিল।
তিনি লিখেছেন, “নির্দিষ্ট কিছু সময়ে লোকজন তাকে দেখবে বলে তাকে একটি খাঁচার শিকের পেছনে আটকে রাখা হয়েছিল এমন সম্ভাবনা খুব কম।”
আর্কাইভে যে পর্বত-সমান তথ্যপ্রমাণ ছিলো সেসব উপেক্ষা করেই তিনি এধরনের প্রশ্ন অব্যাহত রাখেন। মি. ব্রিজেস লিখেছেন, “এতো আগের ঘটনার বিষয়ে যে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, যা কিছু করা হয়েছিলো ভালো উদ্দেশ্যেই সেসব করা হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের লোকজনের আগ্রহ ছিলো ওটা বেঙ্গার বিষয়ে।”
ওটা বেঙ্গার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর সব বর্ণনা একত্রিত করে ১৯৯২ সালে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার একজন লেখক ছিলেন ওটা বেঙ্গাকে যিনি ধরে এনেছিলেন সেই স্যামুয়েল ভার্নারের নাতি।
১৯০৪ সালে সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায় প্রদর্শন করার জন্যে ওটা বেঙ্গাসহ আরো কয়েকজনকে ধরে আনতে মি. ভার্নার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কঙ্গো গিয়েছিলেন।
বইটিতে ওটা বেঙ্গার সাথে স্যামুয়েল ভার্নারের বন্ধুত্বের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে যে ওটা বেঙ্গাকে ধরার সময় তিনি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
তখনকার একটি সংবাদপত্র লিখেছে, নিউ ইয়র্কের লোকজন যখন চিড়িয়াখানায় তাকে দেখতে আসতো তখন তাদের কিছু করে দেখাতে তিনি আনন্দ পেতেন।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, এভাবে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্রংস চিড়িয়াখানা পরিচালনাকারী সংস্থাটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে একের পর এক ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে।
এমনকি বর্তমানেও যখন এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে তখনও ওটা বেঙ্গাকে যে তিন সপ্তাহের জন্য বানরের খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেটি উল্লেখ না করে বলা হয়েছে- কয়েক দিনের জন্য।
ব্রংস চিড়িয়াখানা পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি এখন বলছে যে ইতিহাসের এই অসম্মানজনক অধ্যায়ের তারা নিন্দা করছে।
তারা এও বলছে, “এই ঘটনার কারণে এবং আমাদের নিন্দা না জানানোর কারণে এতোদিন যে অনেক মানুষ আহত বোধ করেছেন তাতে আমরা অনুতপ্ত।”
BBC-Bangla
Leave a Reply