বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন
বাগেরহাট: বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না বাগেরহাটের চিংড়ি চাষিদের। কয়েক বছর ধরে বাগেরহাটের চিংড়ি শিল্পের উপর নানা বিপর্যয় শুরু হয়েছে।
একের পর এক চিংড়ির পোনা উৎপাদনের বাণিজ্যিক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয় মারাত্মক পোনা সংকট। এর সঙ্গে প্রতি বছরই রয়েছে দুই থেকে তিনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
২০১৬ থেকে ২০১৯ এর প্রথম পর্যন্ত পোনা সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি চিংড়ির সুনাম নষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও চাষিরা নিজেদের মূলধন নিয়ে মোটামুটি টিকে ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩ মে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ফনির পর থেকে চিংড়ি চাষিদের বিপদ যেন কাটছেই না। যখনই একটু ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন চিংড়ি চাষিরা তখনই শুরু হয়েছে একের পর এক আঘাত। এভাবে চলতে থাকলে আর কতদিন চিংড়ি চাষ করবেন মানুষ তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফনির আঘাতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে যায়। চাষিদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ফনির ক্ষত শুকাবার আগেই নতুন করে ঘেরে মাছ ছেড়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন চাষিরা। পরে একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর রাতে আরেকটি বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েন চিংড়ি চাষিরা। একরাতেই ঘেরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে জেলার ফকিরহাট, চিতলমারী, কচুয়া ও মোল্লাহাটের চিংড়ি চাষিদের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন অনেক চাষিকে ঘেরের পাড়ের মাটিতে মণকে মণ চিংড়ি মাটিচাপা দিতে দেখা গেছে। এ যাত্রায় চাষিদের প্রায় ৩০ কোটি টাকার উপরে লোকসান গুনতে হয়েছিল শুধু ফকিরহাট উপজেলার চাষিদের। লোকসান কাটাতে না পেরে পথে বসতে হয়েছে অনেককে।
আবারও নতুন স্বপ্ন নিয়ে ঘের পরিচর্যা ও পোনা ছাড়া শুরু করেন চাষিরা। এর মাত্র দেড় মাসের মাথায় ৯ নভেম্বর বাগেরহাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। বুলবুলের আঘাতে সরকারি হিসেবে ৭ হাজার ২৩৪টি মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে চাষিদের দাবি ছিল ভেসে যাওয়া ঘেরের সংখ্যা ১০ হাজারের কিছু কম নয়। বুলবুলের পরেই সেচে, শুকিয়ে ও চুন দিয়ে পোনা ছাড়ার জন্য ঘের প্রস্তুত করেন চাষিরা। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাগেরহাটের ঘেরগুলোতে নদী খালে পানির স্বল্পতার সঙ্গে ছিল পোনা সংকট। বেশি দাম দিয়ে পোনা কিনে ছাড়া হয়েছে ঘেরে।
মার্চের দিকে আসে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস। করোনা পরিস্থিতিতে চাষিরা উভয় সংকটে পড়েন। বিদেশে মাছ রপ্তানি বন্ধ থাকায় ঘেরে বড় হওয়া চিংড়িও বিক্রি করতে পারেননি চাষিরা। এর মধ্যে ধার দেনা করে স্বপ্ন পূরণের আশায় বেঁচে থাকার তাগিদে ঘেরে থাকা মাছের খাবার যোগার করেছেন চাষিরা। এর মধ্যেই এ বছরের ২০ মে বাগেরহাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানের আঘাতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসেবে বাগেরহাটের চার হাজার ৬৩৫টি মৎস্য ঘের পানিতে ডুবে যায়। চাষিদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তবে এসময়ও চিংড়ি চাষি ও চাষি সমিতির নেতৃবৃন্দ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি দাবি করেছিলেন।
আম্পানের পরে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও চাষিরা আবারও পোনা ছেড়েছিল মৎস্য ঘেরে। সেই পোনা বড় হওয়ার পরে কিছুদিন ধরে বিক্রি শুরু করেছেন চাষিরা। এর মধ্যেই গেল পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় আবারো বাগেরহাটের কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে যায়। নিজের চোখের সামনে লাখ লাখ টাকার বিক্রয়যোগ্য মাছ ভেসে যায় ঘের থেকে। এভাবেই কাটছে বাগেরহাটের চিংড়ি চাষিদের জীবন। তবে একের পর একই ধরনের বিপর্যয় লেগে থাকলে এক সময় চাষিরা চিংড়ি চাষ ছেড়ে দেবেন বলে আশঙ্কা করেছেন জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি মুহিতুর রহমান সুমন।
মুহিতুর রহমান সুমন বলেন, একের পর এক চিংড়ি শিল্পের ওপর নানা বিপদ লেগেই আছে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণে আমাদের লোকসান হচ্ছে। এরপরেও চাষিরা চিংড়ি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। কারণ দেশের সব থেকে বেশি চিংড়ি উৎপাদন হয় বাগেরহাট জেলায়। কিন্তু বাগেরহাট জেলার চিংড়ি চাষিরা আজ অবহেলিত। প্রাকৃতিক বড় বড় বিপর্যয় উপেক্ষা করেও চাষিরা এই শিল্পের সঙ্গে রয়েছেন। কিন্তু সরকারিভাবে তেমন কোনো কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা আমাদের চাষিরা পায় না। সরকারের পক্ষ থেকে চাষিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও সঠিক কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে এক সময় চাষিরা চিংড়ি চাষ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাবেন। ঋণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চিংড়ি চাষিদের জন্য সরকারিভাবে বীমা পদ্ধতি চালুর দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, বাগেরহাটের চিংড়ি চাষিদের আমরা অনেক প্রশিক্ষণ দিয়েছি। কিন্তু বাগেরহাটের চাষিদের আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে কিছু প্রশিক্ষণের বরাদ্দ থাকা সত্বেও আমরা করাতে পারিনি। এই মৌসুমেই যেভাবে হোক চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া চিংড়ি চাষিদের জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে এই টাকাগুলো সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হবে বা হচ্ছে। এই টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে মৎস্য অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করলে চাষিরা সহজে ঋণগুলো পাবেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
Leave a Reply